অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কি

 

অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি

অর্থনৈতিক উন্নয়ন
Economic Development


অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে বুঝায় দীর্ঘমেয়াদে কোন দেশের প্রকৃত জাতীয় আয় অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্যভাবেও বলা যায়, যে প্রক্রিয়ায় কোন অর্থনীতিতে দীর্ঘকাল ব্যাপী প্রকৃত জাতীয় আয়, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও জীবনযাত্রার মান অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে তাকে বলা হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন।


অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি সে বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা কোন সুনির্দিষ্ট ও সার্বজনীন সংজ্ঞা দিতে পারেননি। কিন্তু বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোন থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। যেমন-

অধ্যাপক লুইস বলেন, "প্রতি ঘন্টায় উৎপাদনের হার বৃদ্ধিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে।" অধ্যাপক পল ব্যারন এর মতে, “সময় ব্যবধানে বস্তুগত সম্পদের মাথাপিছু উৎপাদনের যে বৃদ্ধি টে তাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলে।"


অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
Economic Growth


সাধারণ অর্থে 'প্রবৃদ্ধি' বলতে পরিবর্তনের হার বুঝায়। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা অগ্রগতি বলতে অধিক জাতীয় উৎপাদন বা জাতীয় আয় বা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকে বুঝায়। একটি দেশের জাতীয় আয় বার্ষিক যে হারে বৃদ্ধি পায়, তাকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বলে। অর্থাৎ একটি দেশে কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে সাধারণত এক বছরে প্রচলিত উৎপাদন ব্যবস্থার অধীনে মোট জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়াকে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি বলা হয়। বিগত বছরের তুলনায় বর্তমান বছরে জাতীয় আয় যতটুকু বাড়ে তাকে বিগত বছরের জাতীয় আয় দিয়ে ভাগ করলে প্রবৃদ্ধির হার পাওয়া যায় ।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তিন ধরনের। যথাঃ


( ১) ধনাত্মক প্রবৃদ্ধিঃ যে ক্ষেত্রে জাতীয় আয় অব্যাহতভাবে বাড়ে, তাকে ধনাত্মক প্রবৃদ্ধি বলে।


(২) ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি: যদি সময় ব্যবধানে জাতীয় আয় হ্রাস পেতে থাকে তবে, তাকে ঋণাত্মক


(৩) শূন্য প্রবৃদ্ধিঃ যদি সময় ব্যবধানে জাতীয় আয় স্থির থাকে অর্থাৎ জাতীয় আয়ের কোনো


অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির  মধ্যে পার্থক্য 
Difference Between Economic Development And Economic Growth


অর্থনৈতিক উন্নয়ন

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি


অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে শুধুমাত্র জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধিকেই বুঝায় না, সাথে সাথে উৎপাদনের কৌশল ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নতিকেও বোঝায়।



অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলো কোন দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু প্রকৃত আয়ের বৃদ্ধি।


কাঠামোগত পার্থক্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি দেশের কাঠামোগত পরিবর্তন সাধন করে।



প্রবৃদ্ধি কোন ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়াই জাতীয় আয়ের উৎপাদন ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি করে।



অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন।

প্রবৃদ্ধি একটি স্বল্পমেয়াদী পরিবর্তন।

দুটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন একই সময় ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।


ঐ দুটি দেশের প্রবৃদ্ধি ঐ সময়ে এক ও অভিন্ন হতে পারে।


অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাণগত ধারণার পাশাপাশি একটি গুণগত ধারণাও প্রকাশ করে।


প্রবৃদ্ধি শুধুমাত্র পরিমাণগত ধারণা প্রকাশ করে।



অর্থনৈতিক উন্নয়ন = অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কাঠামোগত পরিবর্তন।



প্রবৃদ্ধি = অর্থনৈতিক উন্নয়ন - কাঠামোগত পরিবর্তন।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির উপর নির্ভর করে, অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি ছাড়া উন্নয়ন' সম্ভব নয় ।



প্রবৃদ্ধি স্বাধীন অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়া প্রবৃদ্ধি  সম্ভব।



অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পূর্বশর্ত হিসাবে | প্রয়োজন দীর্ঘকালব্যাপী উর্ধ্বমুখী ধনাত্মক প্রবৃদ্ধি অর্জন

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য পূর্বশর্ত হিসাবে প্রয়োজন উৎপাদনের উপকরণের সহজলভ্যতা ও বিনিয়োগ ইত্যাদি।




অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সকল খাতের ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন একটি বিশেষ খাতের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মাধ্যমে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।


অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে একটি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটে।


অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি নাও ঘটতে পারে

অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ণয় করা জটিল ও অধিক সময় সাপেক্ষ

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ণয় করা তুলনামূলকভাবে সহজ


অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রতি
Nature Of Economic Development 


মানব সম্পদ উন্নয়নই হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার সমন্বয়, যেখানে কোন দেশের জনগণের উন্নত জীবনযাপনের নিশ্চয়তা পায়। 

অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি প্রকৃতিকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

 

প্রাথমিক উন্নয়ন (Early Development) : উন্নয়নের এই স্তরে শ্রমের তীব্র ব্যবহার হয়।

অর্থাৎ শ্রম নিবিড় উৎপাদন কৌশল ব্যবহৃত হয় ।


দ্রুত উন্নয়ন (Accelerated Development) : উন্নয়নের এই স্তরে শ্রমের ব্যবহার ক্রমশ হ্রাস পেয়ে মূলধনের বা যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ শ্রম নিবিড় উৎপাদন কৌশলের পরিবর্তে মূলধন নিবিড় উৎপাদন কৌশলের ব্যবহার দ্রুত বাড়তে থাকে।


সমৃদ্ধি পরবর্তী উন্নয়ন (Development beyond Affluence) : উন্নয়নের এই স্তরে পেশাগত ব্যবস্থাপনা এবং তত্ত্ববধান স্তরে উন্নতমানের ও দক্ষ শ্রম ব্যবহৃত হয়।


উন্নয়ন অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীতা
Necessity of Studying Development Economics


উন্নয়ন অর্থনীতি অধ্যয়নের মাধ্যমে ছাত্ররা উন্নয়নশীল জাতিসমূহের সম্পর্কে কিছু জটিল প্রশ্ন ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারে এবং সেই সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়ে চিন্তা করতে পারে। উন্নয়ন অর্থনীতি যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে এবং এ বিষয়টি অধ্যয়নের মাধ্যমে ছাত্ররা যেসব বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবে নিম্নে সেগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।


১। উন্নয়নের সঠিক অর্থ, উন্নয়নের বিভিন্ন ধারণা এবং উন্নয়নের তত্ত্বসমূহ উন্নয়ন প্রক্রিয়া ভালোভাবে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে কিভাবে অবদান রাখে তা উন্নয়ন অর্থনীতি অধ্যায়নের মাধ্যমে জানা যাবে।


২। উন্নত বিশ্বের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ঐতিহাসিক রেকর্ড কেমন ছিল? বর্তমানে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোতে উন্নয়নের জন্য একই ধরনের পরিবেশ বিরাজ করছে কিনা? উন্নত দেশগুলো তাদের শিল্পোন্নয়নের সময় কি ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছিল? এ সকল বিষয় জানা যাবে উন্নয়ন অর্থনীতি 

অধ্যায়নের মাধ্যমে।


৩। অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে উন্নয়নের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে এবং    সাফল্যজনকভাবে উন্নয়নে ভূমিকা রাখে তা উন্নয়ন অর্থনীতির মাধ্যমে বোঝা যাবে।


৪। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উৎসগুলো কী? কিছু কিছু দেশ দ্রুত অর্থনৈতিক

উন্নতি করছে যখন অনেক দেশ দরিদ্র থেকে যাচ্ছে এর কারণ অনুধাবন করা যায়।

৫। প্রবৃদ্ধি অর্জনের বাধা/প্রতিবন্ধকতাগুলো কি তা জানা যায়।


৬। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর ভূমিকা জানা যায়।


৭। চরম দারিদ্র্যের কারণ এবং দরিদ্রদের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্রদের অবস্থার উন্নয়ন করা যায় কিভাবে।


৮। জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি কিভাবে বাধাগ্রস্ত করে তা জানা যায়।


৯। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেকারত্ব ও অপূর্ণ নিয়োগ বেশি থাকে কেন? এবং কেন উন্নয়নশীল

দেশগুলোতে গ্রাম থেকে চাকুরির খোঁজে শহরে স্থানান্তরিত হয়? তার কারণ উপলব্ধি করা যায়।


১০। সম্পদশালী সমাজ স্বাস্থ্যবান সমাজও কারণ, তাদের পক্ষে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে অধিক যত্নবান হওয়ার মত অধিক সম্পদ যোগান দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সুস্বাস্থ্য কি সাফল্যজনক অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিশ্চয়তা দিতে পারে?


১১। উন্নয়নের সম্ভাবনার উপর দূর্বল জনস্বাস্থ্যের প্রভাব কতখানি এবং এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার জন্য কি কি প্রয়োজন হয়?


১২। LDC গুলোতে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা কি প্রকৃতই অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাড়াতে সহায়ক


১৩। LDC গুলোতে এখনও অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা গ্রামে বসবাস করে, কিভাবে এসব দেশের


১৪। পরিবেশগত টেকসই উন্নয়ন বলতে আমরা কি বুঝি? সার্বিক পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী কারা, উত্তরের ধনীরা না কি দক্ষিণের দরিদ্র দেশগুলো?


১৫। উন্নয়নের সমস্যাগুলোর সমাধানে মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক বেসরকারীকরণ কি ধরনের ভুমিকা পালন করতে পারে? কিংবা LCD গুলোর সংস্কার এখনও তাদের অর্থনীতিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে কি?


১৬। অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ দুর্বল উন্নয়ন নীতি নির্বাচন করে কেন, এবং তাদের নীতি পছন্দের উন্নয়নে কি পদক্ষেপ গ্রহণ ক্রা যেতে পারে?


১৭। বিশ্বায়ন কি, এবং এটা কিভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রভাবিত করছে?


১৮। বাণিজ্য থেকে কিভাবে লাভবান হওয়া যায়? এবং বাণিজ্যের লাভ কিভাবে বন্টিত হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে?


১৯। কৃষি পণ্যের মতো প্রাথমিক পণ্য রপ্তানী কি বাড়ানো উচিত না কি সকল LDC এর জন্য

তাদের নিজস্ব ম্যানুফেকচারিং শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে শিল্পায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার? 


২০। ধনী দেশগুলো হতে বৈদেশিক অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রভাব কি? উন্নয়নশীল দেশগুলোর কি

আর বেশি সাহায্যে পাওয়ার চেষ্টা করা উচিত? যদি তাই হয়, তা হলে কোন্ শর্তাধীনে এবং কি কি খাতের জন্য? উন্নত দেশগুলোরও কি সাহায্য অব্যাহত রাখা উচিত? যদি তাই হয়, তাহলে কোন্ শর্তাধীনে এবং কোন্ কোন্ খাতের জন্য।


২১। উন্নয়নের জন্য আর্থিক ও রাজস্ব নীতির ভূমিকা কি? অধিক প্রতিরক্ষা ব্যয় কি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে না কি কমাতে সাহায্য করে?


২২। ক্ষুদ্র ঋণ কি এবং দারিদ্র্য নিরসনে ও তৃণমূল পর্যায়ের উন্নয়নে এর ভূমিকা ও সীমাবদ্ধতা কি? উন্নয়ন অর্থনীতি অধ্যয়নের মাধ্যমে উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে এবং তার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যাবে। তাই একটি দেশের সকল নাগরিকেরই (বিশেষ করে অর্থনীতির ছাত্রদের) উন্নয়ন অর্থনীতি অধ্যয়ন করা জরুরী।


উন্নয়নের তিনটি উদ্দেশ্য
Three Objectives of Development


উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য প্রত্যেক সমাজেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ন্যূনতম নিম্নের তিনটি বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে হবে।


(১) ন্যূনতম জীবনযাপনের জন্য মৌলিক প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন- খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ইত্যদিব পর্যাপ্ততা বৃদ্ধি এবং সুষম বন্টনের ব্যবস্থা।


(২) জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি। যার জন্য প্রয়োজন উচ্চতর আয়স্তর অর্জন, অধিকতর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, উন্নত শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক ও মানবীয় মূল্যবোধ বৃদ্ধি। উক্ত বিষয়গুলো ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে অর্জন করতে পারলেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।


(৩) মানব জীবনকে সুন্দর এবং উপভোগ্য করে তুলতে হলে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, সামাজিক বিধি- নিষেধ, দুর্দশা, পুরোনো মূল্যবোধ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন বাহ্যিক বাধাও দূর করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন সুন্দর জীবনযাপনের জন্য মানুষের পছন্দের স্বাধীনতা ও পরিধি বৃদ্ধি করে। অধিকতর সম্পদ মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি বেশি বিশ্রাম, বেশি দ্রব্য ও সেবা ভোগ ইত্যাদি পছন্দের ব্যাপারে অধিক স্বাধীনতা প্রদান করে।


উন্নয়নের প্রধান তিনটি মানদন্ড : উন্নয়নের মৌলিক প্রয়োজনীয় ধারণা
Three Core Values of Development : Basic Needs Approaches to Economic Development


সাধারণ অর্থে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে জাতীয় আয়ের অব্যাহত বৃদ্ধিকে বোঝায়। তবে জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয় বাড়লেও যদি কোন দেশে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও আয় বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস না পায় তবে সে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে বলা যায় না।


অর্থনীতিবিদ Denis Goulet: অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যুক্তি দেন যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পূরণ তিনটি মৌল ধারণা বা মানদন্ডের ওপর প্রতিষ্ঠিত। নিম্নে উন্নয়নের তিনটি মৌলিক মানদন্ড/ধারণা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল।


১। জীবন রক্ষা : মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষমতা (Life Sustenance: Ability to provide basic needs):

জীবন বাঁচানোর জন্য সমাজের সব মানুষের মৌলিক চাহিদা রয়েছে। যেমন- খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা। এগুলোর কোন একটি অনুপস্থিত থাকলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, একটি দেশে অর্থনৈতিক অনুন্নয়ন হচ্ছে। তাই দেশের মানুষ যাতে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সামর্থ্য হয় সেজন্য যতবেশি লোককে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত করা যায় ততই মঙ্গল। তা না হলে খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার অভাবে সমাজের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বাড়ে যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সুতরাং মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু ব্যক্তি ও সামাজিক ক্ষেত্রে ক্রমাগত অর্থনৈতিক উন্নতি না হলে মানব সম্পদ উন্নয়নের সম্ভাবনা কমে যায়। সুতরাং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।


(i) জনগণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি;


(ii) চরম দারিদ্র্যতা দূর করা;


(iii) অধিক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা;


(iv) সমাজের আয় বৈষম্য হ্রাস করা;


 ২। আত্ম শ্রদ্ধাবোধ (Self-Esteem): সুন্দর জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন আত্মশ্রদ্ধাবোধ। তবে

এই আত্মশ্রদ্ধাবোধ বিভিন্ন ব্যক্তি, জাতি ও বিভিন্ন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। আধুনিক যুগে যেখানে উন্নত দেশগুলোতে মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক চেতনা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে পুরানো মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে বস্তুগত সম্পদকেই আত্মসম্মান বোধের মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এজন্য যেসব দেশের সম্পদ বেশি এবং উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী সেসব দেশকেই উন্নত দেশ বলে গণ্য করা হয়। অধ্যাপক D. Goulet তাই মন্তব্য করেন যে, তৃতীয় বিশ্বের জনগণ তাদের নিজেদের এবং দেশের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতি ক্রমাগত আগ্রহী হয়ে উঠছে। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশ ও জাতিকে আত্মমর্যাদাশীল করে তোলা সম্ভব। যে জাতি কিংবা যে দেশের জনগণ তাদের মৌলিক প্রয়োজন মেটাবার জন্য ক্রমাগত আগ্রহী হয় সে জাতি ও দেশ আন্তর্জাতিকভাবে শ্রদ্ধা ও মর্যাদা লাভ করে।


৩। বাহ্যিক বাধা/অসুবিধা থেকে স্বাধীনতা (Freedom from servitudes) : মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং মানব জীবনকে সুন্দর ও উপভোগ্য করে তোলতে হলে সামাজিক কুসংস্কার, অজ্ঞতা, পুরানো মূল্যবোধ ইত্যাদি থেকে মুক্ত হতে হবে। সেই সাথে বিভিন্ন বাহ্যিক বাধা/সীমাবদ্ধতাও দূর করা প্রয়োজন। অধ্যাপক A. Lewis মনে করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সুন্দর জীবনযাপনের জন্য মানুষের পছন্দের স্বাধীনতা ও পরিধি বৃদ্ধি করে। সম্পদ একদিকে প্রকৃতির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে এবং অন্যদিকে খাদ্য, আশ্রয়, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণে সাহায্য করে। তাছাড়া সম্পদ মানুষকে বেশি বিশ্রাম, বেশী দ্রব্য ও সেবা ভোগ ইত্যাদি পছন্দের ব্যাপারে অধিক স্বাধীনতা প্রদান করে। করে। সুতরাং দেখা যায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন একাধারে বস্তুগত ও মানসিক অবস্থার কথা প্রকাশ করে যা উন্নত মানবীয় জীবন (More Human Life) এর নিশ্চয়তা প্রদানে সক্ষম। কাজেই বলা যায়, উপরোক্ত তিনটি উপাদান থাকলে একটি দেশের পক্ষে কার্যকর অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব। এজন্যই উপরোক্ত তিনটি উপাদানের মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণা প্রদান করা হয় তা উন্নয়নের মৌলিক প্রয়োজনীয় কৌশল নামে অভিহিত।


অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিমাপক/সূচক/নির্ণায়কসমূহ
Determinants/Indicators / Measuring Of Economic Development


অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান পরিমাপক হচ্ছে মাথাপিছু আয়। সাধারণত যেসব দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বেশি তাদেরকে উন্নত দেশ বলা হয়। কিন্তু মাথাপিছু আয় বেশি হলেও কোন অর্থনীতিকে উন্নত বলা যাবে না। কারণ, মাথাপিছু আয় খুব বেশি থাকা সত্ত্বেও যদি অর্থনীতি স্বনির্ভর না হয়, স্বকীয় ধারায় পরিচালিত না হয়, বিদেশী প্রযুক্তি নির্ভর হয় এবং খাদ্যের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল, তাহলে উন্নত দেশ বলা যাবে না। যেমন- মাথাপিছু আয় খুব বেশি না হলেও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি স্বকীয় ধারায় পরিচালিত। কিন্তু কুয়েত, সৌদি আরবের মাথাপিছু আয় বেশি হওয়া সত্ত্বেও তাদের অর্থনীতি স্বধারায় পুষ্ট না। কাজেই এসব দেশকে উন্নত দেশ বলা যাবে না। নিম্নে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিমাপক/ সূচকগুলো আলোচনা করা হলো।


১। মাথাপিছু আয়: অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান নির্ধারক হলো জনগণের মাথাপিছু আয়। মাথাপিছু আয় দ্বারা সহজেই একটি দেশের সাথে অন্যদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার তুলনা করা যায়। মাথাপিছু আয়কে কোন দেশের দ্রব্য ও সেবার উৎপাদনের নির্ধারক হিসেবে দেখা হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় মাথাপিছু প্রকৃত আয় যাদের বেশি, তাদের মৃত্যুহার কম, শিক্ষার হার বেশি, ক্যালরী গ্রহণ বেশি, প্রোটিন গ্রহণ বেশি। তাই মাথাপিছু আয় হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি

অর্থনৈতিক উন্নয়নের একমাত্র পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করা ঠিক নয়। কারণ, GNP এর মধ্যে অনেক দ্রব্য ও সেবা অন্তর্ভুক্ত হয় না।


২। মৌলিক চাহিদা পূরণ: মানুষের মৌলিক চাহিদা বলতে খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান বোঝায়। যে দেশে মাথাপিছু খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান বেশি সেখানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে বলা যায়। এসব মৌলিক উৎপাদনের সূচক দ্বারা অর্থনেতিক উন্নয়নের স্তর সম্পর্কে অনেকটা অবহিত হওয়া যায়।


৩। আর্থিক কল্যাণ: আর্থিক কল্যাণের মাধ্যমে অনেকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপ করেন।

এদের মতে মাথাপিছু প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পেলে আয় বৈষম্য হ্রাস পাবে যা দেশের উন্নতি নির্দেশ করে।

Okun এবং Richardson এর মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো বৈষয়িক উন্নতির অব্যাহত প্রসার যা দ্রব্য ও সেবার বর্ধিত উৎপাদনের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।


৪। জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: জীবনধারনের মান হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপের অন্যতম সূচক। জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হলে বোঝা যাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন তখন হয় যখন-


(i) মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায়।


(ii) শিক্ষার হার বৃদ্ধি পায়।


(iii) দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল থাকে।


(iv) গড় আয়ু বৃদ্ধি পায় এবং জন্ম ও মৃত্যুহার হ্রাস পায়।


(v) বেকার সমস্যা সর্বনিম্ন স্তরে থাকে।


(vi) বাসস্থান সমস্যা অনুপস্থিত থাকে।


(vii) জনগণের মুক্ত ও স্বাধীনভাবে মতামত রেখে জাতীয় উন্নতি।



৫। স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি: আধুনিক অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, কর্মক্ষম জনশক্তির উপর উন্নয়নের গতি বহুলাংশে নির্ভর করে। কর্মক্ষম জনশক্তি আবার স্বাস্থ্য সুবিধা এবং পুষ্টিমানের উপর অনেকটা নির্ভর করে। এজন্য দেশের জনগণের স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সূচক অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মানদণ্ড হতে পারে।


৬। আয় বণ্টন: আধুনিক অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, আয়ের বন্টনের উপরেও অর্থনেতিক উন্নয়ন নির্ভর করে। আয়ের সুষম বন্টন গণমানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সহায়ক। কিন্তু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেলেও যদি আয়ের অসম বন্টন হয় অর্থাৎ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে আয়ের বড় অংশ কেন্দ্রীভূত থাকে তবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের কোন নিশ্চয়তা থাকে না। তাই যে সকল দেশে আয়ের বন্টন সুষম হয় সেসব দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে বলা যায়।


৭। অবকাঠামোগত অবস্থা: উন্নত যোগাযোগ এবং যাতায়াত ব্যবস্থা দ্রুত উন্নয়নের জন্য সহায়ক। তাই কোন দেশের অবকাঠামোগত অবস্থাকে উন্নয়নের অন্যতম সূচক হিসেবে গণ্য করা যায়।


৮। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সহায়ক। এরূপ রাষ্ট্রীয় কাঠামো রাজনৈতিক পরিবেশের উপর নির্ভর করে। এর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। এই অর্থে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম সূচক বলা হয়।


৯। দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং আয় হ্রাস: যদি কোন দেশে জনগণের দারিদ্র্যতা, বেকারত্ব এবং আয় বৈষম্য ক্রমশ হ্রাস পায় তবে নিঃসন্দেহে ঐ দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে বলা যায়।


১০। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো: কুসংস্কারমুক্ত একটি গতিশীল সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক

 কাঠামো উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট সহায়ক। তাই সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম সূচক বা মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা যায়।


১১। জীবনের উৎকর্ষতা: আধুনিক অর্থনীতিবিদরা মাথাপিছু প্রকৃত আয়ের মাপকাঠিতে সন্তুষ্ট নন। তাঁরা আর একটি নতুন মাপকাঠি ব্যবহারের কথা বলেন। এর নাম জীবনের মান ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধি। জীবনের এই উৎকর্ষতা নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের উপর।


(ক) দেশের মৃত্যুর গড় সম্ভাবনা হ্রাস পায় বা অধিককাল বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি;


(খ) দেশে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস এবং


(গ) স্বাক্ষরতার গড় হার বৃদ্ধি।


এই তিনটি মানের সাহায্যে জীবনের উৎকর্ষতার মাত্রা বের করা যায়। এই মাপকাঠিতে সবচেয়ে উন্নত দেশ সুইডেন। সেখানে বেঁচে থাকার গড় সম্ভাবনা ৭৫ বছর, শিশু মৃত্যুর হার ৯ এবং স্বাক্ষরতার হার প্রায় ১০০% ১২। সুশাসন এবং প্রশাসনিক দক্ষতা: সরকারের সুশাসন এবং প্রশাসনিক দক্ষতা অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ, শাসন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা এবং দৃঢ়তা থাকলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে না।


১৩। প্রাকৃতিক সম্পদ : জমি, বন, আবহাওয়া, খনিজ, পানি ইত্যাদি হলো প্রাকৃতিক সম্পদ। উন্নত মানের এই সম্পদ কোন দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলে সেখানে দ্রুত উন্নয়ন হতে পারে। যে সব দেশে এরূপ সম্পদ কম সেখানে উন্নয়নের গতি দ্রুত হয় না।


১৪। মানব সম্পদ: জনসংখ্যা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান নির্ধারক বলা যায়। কারণ, বিভিন্ন সম্পদ দেশে প্রচুর পরিমাণে থাকলেও যদি উন্নত ও দক্ষ মানব সম্পদ না থাকে তবে তার সুষ্ঠু। ব্যবহার হবে না। এতে উন্নয়ন ব্যাহত হবে। কোন্ ধরনের সম্পদ কি কি দ্রব্য ও সেবা উৎপাদনে উপযোগী সে সম্পর্কে মানুষের ভাল ধারণা থাকতে হবে। তাহলেই দ্রুত উন্নয়ন হতে পারে।


 ১৫। মূলধন গঠন : মূলধন গঠনের উপর অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশেষভাবে নির্ভর করে। মূলধন বলতে এমন সব উৎপাদিত দ্রব্য বোঝায় যা অন্য পণ্য উৎপাদনে উপকরন হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যেমন- যন্ত্রপাতি কোন শিল্পের উৎপাদিত পণ্য। এগুলো আবার অন্য কোন শিল্পের পণ্য উৎপাদনের জন্য উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা যায়। তাই যন্ত্রপাতিকে মূলধন বলা যায়। মূলধন গঠন এবং মূলধনের ব্যবহার


অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাধা/প্রতিবন্ধকতাসমূহ
Obstacles to Economic Development


উন্নয়নশীল দেশগুলোর দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে যে সকল বাধা রয়েছে সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো।


১। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র : অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দেয় দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র ধারণাটি সর্বপ্রথম অধ্যাপক Ragner Nurkse ১৯৫২ সালে উপস্থাপন করেন। তিনি কায়রোতে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন 'A country is poor, because it is poor.' অর্থাৎ দারিদ্র্যতাই দারিদ্র্যের কারণ। Nurkse এর বক্তব্যটা এমন, একটি দেশ দরিদ্র বলে আয় কম সঞ্চয় কম বিনিয়োগ কম নিয়োগ কম আয় কম, এভাবে চক্রাকারে আবর্তিত হয়। এই দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র অনুন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্যতম বাধা হিসাব কাজ করে। ←


২। অপর্যাপ্ত পুঁজি : অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান মূলধন। সাধারণত মূলধন বা পুঁজি বলতে ঘরবাড়ী-যন্ত্রপাতি, ফ্যাক্টরী ইত্যাদি এবং দ্রব্যের মজুত ভান্ডারকে বোঝায়। পুঁজি বা মূলধনের স্বল্পতাই কোন দেশের দরিদ্র অবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ। অনুন্নত দেশে মাথাপিছু পুঁজির   পরিমাণ খুবই কম। এছাড়া অনুন্নত দেশে পুঁজি গঠনের হারও কম। অথচ জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু আশানুরূপ বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে না।


৩। কৃষির নিম্ন উৎপাদনশীলতা : অনুন্নত দেশের কৃষির উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম থাকে। মুষ্টিমেয় কয়েকটি দ্রব্য উৎপাদন করে। সনাতনী উৎপাদন ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকে। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের পথে

অনেক সমস্যা জড়িত থাকে। সেচ-সার-বীজ প্রযুক্তি এবং যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন এখানে হয় না। কাজেই উৎপাদনশীলতা কম থাকে, যা কম আয় সৃষ্টি করে এবং উন্নয়নের প্রতিবন্ধক।


৪। শিল্পের অনগ্রসরতা : অনুন্নত দেশে মূলধনের অভাব এবং উদ্যোক্তার অভাব বিদ্যমান। এছাড়া শিল্পোন্নয়নের জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ থাকে না। ফলে শিল্পায়ন বিকশিত হয় না। উন্নত দেশে যেখানে ৩০-৩৫ ভাগ জাতীয় আয় আসে শিল্পখাত থেকে, সেখানে অনুন্নত দেশে মাত্র ১০ থেকে ১৫ ভাগ জাতীয় আয় আসে শিল্পখাত থেকে। শিল্পের অনগ্রসরতা উন্নয়নের প্রতিবন্ধক।


৫। দক্ষ ও অভিজ্ঞ উদ্যোক্তার অভাব: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ স্যুম্পিটার মনে করেন উদ্যোক্তা হলো উন্নয়নের কেন্দ্র বিন্দু। কোন অর্থনীতির উন্নয়ন নির্ভর করে উদ্যোক্তার কার্যাবলীর উপর। অনুন্নত দেশে ঝুঁকি গ্রহণকারী উদ্যোক্তা শ্রেণীর অভাব থাকে। এজন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না।


৬। নিরক্ষরতা: অনুন্নত দেশের জন্মহার বেশি, মৃত্যুহারও বেশি থাকে, তবে জন্মহার মৃত্যুহারের চেয়ে বেশি থাকে। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত এবং সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত থাকে বেশিরভাগ মানুষ যা উন্নয়নে প্রতিবন্ধক।


৭। রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা: অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোন দেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও স্থিতিশীলতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার উপর নির্ভর করে। কারণ, রাজনৈতিক দর্শন দ্বারাই অর্থনৈতিক দর্শন নির্ধারিত হয়। আবার, উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন প্রশাসনের দক্ষতার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই দুটি উপাদান অনুন্নত দেশে অনুকূল পরিলক্ষিত হয় না। এর ফলে এসব দেশ অনুন্নয়নের সীমায় আবদ্ধ থাকে।


৮। বেকার সমস্যা: অনুন্নত দেশের শ্রম শক্তির এক বিরাট অংশ বেকার থাকে। মৌসুমী বেকার, অর্ধবেকার সবচেয়ে বেশী পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত মোট শ্রমশক্তির ২০-৩০ ভাগ বেকার থাকে। বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির ৩০ ভাগই বেকার। অনুন্নত দেশে ঋতুকালীন বেকারত্ব বিদ্যমান রয়েছে। শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কম থাকে। যুগোপযোগী শ্রমিকের সরবরাহ থাকে না।


৯। প্রাকৃতিক সম্পদের অবস্থা: অনুন্নত দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ কম থাকে। কোন কোন সম্পদ অব্যবহৃত থাকে, আবার কোথাও অপব্যবহার হয়। কারিগরী অবস্থা, মূলধনের অভাব এবং উদ্যোক্তার অভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ পূর্ণ ব্যবহার হয় না যা উন্নয়নের জন্য প্রতিবন্ধক।


১০। বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রতিকূল ভারসাম্য: অনুন্নত দেশগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বৈদেশিক বাণিজ্যের উপর নির্ভর করে। এছাড়া বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া দেশগুলো আদৌ চলতে পারে না। বাংলাদেশে রপ্তানী আয় দ্বারা আমদানী ব্যয়ের তিনভাগের দুইভাগ মেটানো যায় মাত্র। উন্নয়ন পরিকল্পনার বড় অংশ বৈদেশিক সাহায্য দ্বারা মেটানো হয়। বেশিরভাগ অনুন্নত দেশে এসব অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। এসব সাহায্য উন্নয়নে সহায়ক হয় না। বরং দিনের পর দিন ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে আর অবাঞ্ছিত শর্ত অর্থনীতির উপর পড়তে থাকে যা উন্নয়নের প্রতিবন্ধক।


বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধাসমূহ এবং সেগুলো দূর করার উপায়
Obstacles to Economic Develpoment of Bangladesh and Way to Remove These


বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে অনেকগুলো মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা বিদ্যমান। নিচে এদেশের অর্থনৈতিক মৌলিক সমস্যাবলী/ উন্নয়নের বাধাসমূহ সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।


১। স্বল্প মাথাপিছু আয় এবং নিম্ন জীবনযাত্রার মান: বাংলাদেশ পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। এই স্বল্প মাথাপিছু আয়ের কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকের জীবনযাত্রারমান দারিদ্র্য সীমার নীচে। বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় মাত্র ১৩১৪ মার্কিন ডলার অন্যদিকে সুইজারল্যান্ডের জনগণের মাথাপিছু আয় ৩৬,০৮০ মার্কিন ডলার। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান কতটা নীচে।


২। কৃষির অনগ্রসরতা: কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা অনুন্নত। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। জাতীয় আয়ের শতকরা ৩০ ভাগ আসে কৃষি থেকে। বাংলাদেশে এখনও প্রাচীন চাষ পদ্ধতি রয়েছে। জমিগুলো খন্ডিত ও বিচ্ছিন্ন, বিনিয়োগের মাত্রাও স্বল্প। আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত উপকরন, সেচ সুবিধা, উত্তম বীজ ও সার ব্যবহার এখন অত্যন্ত সীমিত। এই অনুন্নত চাষ পদ্ধতির কারণে বাংলাদেশের উৎপাদন অন্যান্য দেশের তুলনায় কম।


৩। শিল্পের অনগ্রসরতা : বাংলাদেশ শিল্পে অত্যন্ত অনগ্রসর। মূলধনের স্বল্পতা, কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির অভাব, কারিগরী ব্যবস্থা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব সর্বোপরি কুশলী উদ্যোক্তার অভাবে এ দেশ শিল্পের দিক থেকে অনুন্নত রয়েছে।


৪। অশিক্ষিত জনসংখ্যা: বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। আয়তনের তুলনায় এখানে লোকসংখ্যা অধিক। বেশীরভাগ জনগণই শিক্ষার আলো হতে বঞ্চিত। এই বিপুল জনসংখ্যাকে উপযুক্ত সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা দিয়ে দক্ষ মানব সম্পদে রূপান্তরিত করতে না পারা বাংলাদেশের অন্যতম মৌলিক সমস্যা।


৫। দক্ষ শ্রমশক্তির অভাব: বাংলাদেশের আর একটি মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা হলো দক্ষ জনশক্তির অভাব। আমাদের পর্যাপ্ত জনশক্তি আছে কিন্তু দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে।


৬। দক্ষ সংগঠকের অভাবঃ বাংলাদেশে উন্নয়নের জন্য দক্ষ সংগঠক প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই স্বল্প। ফলে শিল্প ও কলকারখানা বা স্বউদ্যোগে কর্মসংস্থান গড়ে তোলার শত ঝুঁকি গ্রহণেচ্ছু ব্যক্তি খুবই কম।


৭। মূলধনের স্বল্পতা: বাংলাদেশের লোকের মাথাপিছু আয় অত্যন্ত কম। তাই সঞ্চয়ের হারও কম। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে মূলধন গঠনের হার কম। আমাদের সঞ্চয়ের হারও খুব কম। উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বজায় রাখার জন্য সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের হার কমপক্ষে ২৫% হওয়া প্রয়োজন।


৮। বেকার সমস্যা: বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক সমস্যা হচ্ছে বেকার সমস্যা।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে হারে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে না ফলে বেকার সমস্যা বেড়েই চলেছে। আমাদের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৩০ ভাগ বেকার। 


৯। অনুন্নত অবকাঠামো : অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কতকগুলো মৌলিক সুযোগ সুবিধা ও

প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠা প্রয়োজন। যেমন- উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, রেলপথ, বাঁধ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, বন্দর, ব্যাংক ইতাদি। অনুরূপভাবে সামাজিক বুনিয়াদ বা অবকাঠামো, যেমন- স্কুল, কলেজ, কারিগরি জ্ঞান, প্রশাসনিক দক্ষতাও গড়ে ওঠা প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশে এর কোনটিই তেমন উন্নত নয়। অনুন্নত অবকাঠামোর জন্য এখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি অত্যন্ত মন্থর।


১০। প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা ও অপূর্ণ ব্যবহার: বাংলাদেশের লভ্য প্রাকৃতিক সম্পদ জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। প্রয়োজনীয় মূলধন ও কারিগরি জ্ঞানের অভাবে আমাদের খনিজ সম্পদের পরিমাণ ও উত্তোলন কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি ভারী শিল্প গড়ে তোলার জন্য লোহা, কয়লা ও অন্যান্য ধাতব পদার্থ আমাদের দেশে কম। শিল্পায়ন প্রয়াস এজন্য ব্যাহত হচ্ছে।


১১। বৈদেশিক বাণিজ্যের উন্নতি: আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আমাদের আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম। বাণিজ্যের এ ঘাটতি অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট বাধা।.


১২। সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের অসুবিধা: স্বাধীনতার পর যে কয়টি পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তার ভিত্তি বাস্তবায়নের মান কোনটিই আশানুরূপ হয়নি। গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন সবসময়ই অবহেলিত ছিল। গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুবিধা বা কুটির শিল্পের যথোপযুক্ত উন্নয়ন এখনও ঘটেনি। নগর জীবনেও নানান জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সামগ্রীকভাবে দারিদ্র্য বিমোচন বা মানুষের জীবনের গুণগত মান উন্নয়নে কোনটিকেই কাঙ্খিত পর্যায়ে আনা সম্ভব হয়নি।


১৩। মুদ্রাস্ফীতি : বাংলাদেশে দ্রব্যসামগ্রীর দাম স্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেশে অস্বাভাবিক নির্ভর ক মুদ্রাস্ফীতি বিরাজমান। এটি অথনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বিরাট বাধা।


১৪। দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র: বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য হলো এখানে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র বিদ্যমান। এখানে লোকের আয় কম বলে বিনিয়োগের পরিমাণ কম। বিনিয়োগ কম হবার ফলে কর্মসংস্থান পূর্ণভা কম।


১৫। ঋণ খেলাপীদের দৌরাত্ম ঋণ খেলাপীরা আমাদের অর্থনীতির প্রধান শত্রু। খেলাপী ঋণ আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে প্রধান বাধা। ঋণ গ্রহীতারা নানা প্রভাব-প্রতিপত্তির মাধ্যমে বিনিয়োগের নামে শত শত কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নির্ধারিত খাতে বিনিয়োগ না করে অন্য কোনো অনুৎপাদন খাতে বিনিয়োগ করে। এই খেলাপী ঋণের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়মিত পরিশোধ করা হলে উক্ত টাকা পুনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতি লাভবান হতো। কিন্তু ঋণ খেলাপীর ফলে দেশ সমৃদ্ধির সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।


১৬। আমদানি নির্ভরতা: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে রপ্তানীর তুলনায় আমদানির আধিক্যের কারণে বাণিজ্যিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি সৃষ্টি করে। ১৯৯৫-৯৬ সালে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১২৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পরবর্তী প্রতিটি আর্থিক বছরে এই ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে আসছে। এই আমদানি নির্ভরতা তথা বাণিজ্যিক ঘাটতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করছে।


অর্থনৈতিক সমস্যাবলী সমাধানের উপায়সমূহ 
Soluation Of Economic Problem


বাংলাদেশে বহুবিধ মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা বিরাজমান। এগুলোর সুষ্ঠু সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে।


১। কৃষির আধুনিকীকরণ: বাংলাদেশ মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। তাই কৃষিব্যবস্থার আধুনিকীকরণ করা উচিত। উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক ঔষধ, কৃষি উপকরণাদির যোগান বৃদ্ধি, সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, কৃষি পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি, কৃষি পণ্যের বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন, ভূমিস্বত্ত্ব ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা হলে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।


২। শিল্পায়ন : জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষির পাশাপাশি শিল্প কারখানা গড়ে তোলা প্রয়োজন। শিল্পকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন কল্পনা করা যায় না। কৃষিজাত পণ্যের বাজার সৃষ্টি বা কৃষিজাত কাঁচামালের সদ্ব্যবহার করতে হলে শিল্পোন্নয়ন জরুরি। বৃহদায়তন শিল্প এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রসার ইত্যাদি পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে দেশের অবস্থার পরিবর্তন আনা যায়।


৩। মূলধন গঠন : বর্তমান কালে শিল্প ও কৃষি উন্নয়ন মূলধন যোগানের উপর নির্ভরশীল। আমাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। জনসাধারণের তাই অধিক সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করতে হবে। ব্যাংকসহ অন্যান্য অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্প্রসারণ ও ব্যাংকসমূহের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার উপরও মূলধন গঠন নির্ভর করে।


৪। প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার: বাংলাদেশের যে সকল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তার উপযুক্ত ও সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দেশের জলবিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।


৫। অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণ: দ্রুত উন্নয়নের স্বার্থে অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। রাস্তাঘাট, পুল, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, ব্যাংক, যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনীকরণ ও সম্প্রসারণের প্রয়োজন রয়েছে। তেমনি শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা সম্প্রসারণ করে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গী উন্নয়নের অনুকূলে আনতে হবে। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হবে।


৬। শিক্ষার বিস্তার: দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। দেশে শিক্ষিতের হার বৃদ্ধির জন্য সার্বজনীন শিক্ষা ও গণশিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে কারিগরী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে আধুনিক প্রযুক্তি সমাজের সর্বস্তরে পৌছে দিতে কারিগরী ও প্রকৌশলগত শিক্ষা বিস্তার একান্ত প্রয়োজন।


৭। কর্মসংস্থান সৃষ্টি: দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা দূর করতে হলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রযুক্তিগত উত্তরণ এজন্য আবশ্যক। স্ব-উদ্যোগে কর্মসংস্থান গড়ে তুলতে একদিকে গ্রামাঞ্চলে যেমন ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে তুলতে হবে, তেমনি মাছ, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু, ফুল ও ফল চাষের সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। বিলম্বে হলেও বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সম্প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে।


৮। বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্য আনয়ন: বাংলাদেশের বাণিজ্যিক লেনদেন ক্ষেত্রে যে ঘাটতি বা ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করে তা দূরীকরণের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রয়োজন এবং মুষ্টিমেয় কয়েকটি দ্রব্যের রপ্তানীর বদলে অধিক সংখ্যক দ্রব্যের রপ্তানী উৎসাহিত করতে হবে। একই সংগে আমদানি কমাতে হবে।


৯। বৈদেশিক সাহায্যের উপযুক্ত ব্যবহার: বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা স্বাধীনতা-পূর্ব ও উত্তর উভয় কালেই লক্ষ্যণীয়। বিপুল পরিমাণে প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্য, ঋণের সুষ্ঠু ও উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারলে দেশে সমৃদ্ধি লাভ হবে এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব হবে।


১০। সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রনয়ণ: বাংলাদেশের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা প্রণয়ন। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি তথা প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি, আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং মানব সম্পদের উন্নয়ন ও আত্মনির্ভরতা অর্জন আমাদের পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন